• ঢাকা
  • রবিবার , ৯ নভেম্বর ২০২৫ , রাত ০৩:২৭
ব্রেকিং নিউজ
হোম / বিনোদন
রিপোর্টার : বিনোদন প্রতিবেদক
মিঠু মনির: আলো-ছায়ার নান্দনিক কারিগর

মিঠু মনির: আলো-ছায়ার নান্দনিক কারিগর

প্রিন্ট ভিউ

বাংলাদেশের সমকালীন সিনেমাটোগ্রাফির জগতে এক অবিচ্ছেদ্য নাম মিঠু মনির। তিনি শুধুই একজন ক্যামেরা অপারেটর নন, বরং প্রতিটি দৃশ্যের মাঝে যিনি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন আলো, ছায়া, রঙ ও রূপের এক অপূর্ব সিম্ফনিতে। তার নান্দনিক ও উত্তরাধুনিক সিনেমাটোগ্রাফিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র জগৎ পেয়েছে অনন্য এক মাত্রা। যার সুফল ভোগ করছে দেশের সমৃদ্ধ মিডিয়াঙ্গন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন মসৃণ এক সিনেমাটোগ্রাফিক ওয়ার্ল্ড। সম্মানের সাথে যে-অবদান উচ্চারিত হবে যুগের পর যুগ, উদ্বুদ্ধ হবে অনাগত আলো-ছায়ার কারিগরগণ। তার অসংখ্য নন্দতাত্ত্বিক সৃজনকর্মের মধ্যে ‘জামদানি’ চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। অনিরুদ্ধ রাসেল পরিচালিত মুক্তি প্রতিক্ষীত ‘জামদানি’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তিনি যেমন ফ্রেম ও মনস্তাত্ত্বের গভীরতা ছুঁয়েছেন, তেমনই অরণ্য পলাশের ‘গন্তব্য’, অনন্য মামুনের ‘ইন্দুবালা’ বা রফিক শিকদারের ‘হৃদয় জুড়ে’-র মতো চলচ্চিত্রে তার ক্যামেরার ভাষা এক নতুন ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। মিঠু মনিরের প্রতিটি শট যেন এক একটি কবিতার ছন্দ, প্রতিটি দৃশ্য যেন জীবন্ত হয়ে বলে ওঠে চরিত্রের অদৃশ্য ব্যথার গল্প।

সিনেমাটোগ্রাফির স্বপ্নবুনন

মনির হোসেন থেকে ‘মিঠু মনির’ হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয় নরসিংদীর হাসনাবাদ গ্রামের মাটিতে। শৈশবের প্রাণবন্ত দুরন্তপনা, কৈশোরের কৌতূহল আর তারুণ্যের আবেগ ও ভালোলাগা নিয়ে তিনি ঢুকে পড়েন সিনেমাটোগ্রাফির জগতে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিনেমাটোগ্রাফির উপর কোর্স সম্পন্ন করে হাতে তুলে নেন ক্যামেরা—যা শুধুমাত্র একটা যন্ত্রই নয়, বরং অনুভবের আয়না। বিশ্বখ্যাত সংবাদমাধ্যম BBC-তে কাজের অভিজ্ঞতা ও ২০১৪ সালে ICC T-20 World Cup-এ লাইভ ক্যামেরা পরিচালনার দুঃসাহসিকতা তাকে পেশাগতভাবে আরও দৃঢ় করে তোলে।

আলো-ছায়ার গভীর ভাষা

‘জামদানি’ চলচ্চিত্রে মিঠু মনিরের সিনেমাটোগ্রাফি এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের গৌরব ও ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম জিআই পণ্য জামদানি শাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কারিগরদের ঘাম, নিঃশ্বাস ও বেদনা তার ক্যামেরার মাধ্যমে যেন শিহরণ তোলে। প্রতিটি ফ্রেমে আছে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, প্লাইট-কম্পোজিশনে আছে এক আবেগময় দৃষ্টি, যা ঐতিহ্যকে কেবল দেখায় না—অনুভব করায়।

তিনি জানেন, সিনেমাটোগ্রাফি কেবল টেকনিক্যাল দক্ষতার ব্যাপার নয়, বরং এটি এক অন্তর্দৃষ্টির কাজ। আলো দিয়ে কীভাবে কোনো চরিত্রের দ্বিধা বোঝানো যায় কিংবা ছায়া দিয়ে কীভাবে সমাজের নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফুটিয়ে তোলা যায়—এই গভীরতা তার কাজকে অনন্য করে তুলেছে।

ফ্রেমিং ও কম্পোজিশনে নিপুণতা

মিঠু মনিরের ক্যামেরার প্রধান শক্তি হলো ফ্রেমিং ও কম্পোজিশন। তার দৃশ্যায়নে প্রতিটি ফ্রেম যেমন ভারসাম্যপূর্ণ, তেমনই সেখানে থাকে চরিত্রের মানসিক অবস্থা ও আবেগের প্রতিচ্ছবি। তিনি প্রতিটি দৃশ্য আগে পড়েন, বোঝেন, তারপর সেই দৃশ্যের অভ্যন্তরীণ ভাষা বের করে আনেন লেন্সের মাধ্যমে। তার মতে—সিনেমাটোগ্রাফি মানে হলো, স্ক্রিপ্টের প্রতিটি শব্দকে রঙ, আলো আর ছায়ার ভাষায় অনুবাদ করা।

‘গন্তব্য’ সিনেমার একটি দৃশ্য—সন্ধ্যার শেষ আলোয় শহরের এক নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া চরিত্র—যেখানে ফ্রেম, রঙ, মোশন সব মিলিয়ে এক নিঃশব্দ আর্তি তুলে আনে। এমন দৃশ্য—তার সিনেমাটোগ্রাফির নিপুণতার প্রমাণ।

রঙ ও শব্দের সংলাপ

মিঠু মনিরের আরেকটি দারুণ শক্তি হলো কালার গ্রেডিংয়ের প্রতি তার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি। তার সিনেমাটোগ্রাফিতে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রতিটি রঙ—একটি গল্প বলে, একটি মনস্তাত্ত্বিক আবস্থা প্রকাশ করে। কোনো দৃশ্যে নীলাভ ছায়া মানে বিষণ্ণতা, আবার উষ্ণ হালকা হলুদ আলো মানে আশার এক ঝলক। এভাবেই তার নিপুণহাত ও অন্তর্দৃষ্টিতে রঙ হয়ে ওঠে ভাষা, আলো হয়ে ওঠে অনুভব।

সাউন্ড ডিজাইন এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথেও তার ভিজ্যুয়াল কাজ করে একত্রে। তিনি বিশ্বাস করেন—ভালো সিনেমাটোগ্রাফি তখনই সম্ভব যখন চোখ ও কান একসাথে অনুভব করে পর্দার অভিজ্ঞতা।

প্রশিক্ষক হিসেবে ভূমিকা: ভবিষ্যতের নির্মাতা গড়ে তোলা

২০২৩ সালে FIFT (Fresh Institute of Film & Television)-এর অধীনে ‘টেলিভিশন ক্যামেরা অপারেশন অ্যান্ড লাইটিং’ কোর্সে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা মিঠু মনিরের জন্য ছিল একটি গর্বের অধ্যায়। একজন শিল্পী যখন শিক্ষক হয়ে ওঠেন, তখন তার অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়ে শত শিক্ষার্থীর মাঝে। তার চোখে-মুখে ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো জ্বলে ওঠে। তিনি বলেন—ছেলে-মেয়েরা যখন ক্যামেরা ধরতে শিখে, তখন যেন তারা এক নতুন বাংলাদেশ আবিষ্কার করে, যেখানে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, এক বিপ্লবের হাতিয়ার। এই হাতিয়ার নিয়ে তরুণরা বিশ্বময় চলচ্চিত্র-বিপ্লবে নিবেদিত হোক—এমনটাই প্রশিক্ষক মিঠু মনিরের প্রত্যাশা।

কাজের তালিকা

মিঠু মনির এ পর্যন্ত কাজ করেছেন—

চারশত পঞ্চাশটিরও অধিক টিভি নাটক, প্রায় এক হাজার পর্বের উপরে টেলিভিশন সিরিজ নাটক করেছেন,

তিনশতাধীক বিজ্ঞাপনচিত্র, শতাধীক সরকারি-বেসরকারি ডকুমেন্টারি ও মিউজিক ভিডিওতে। চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—’গন্তব্য’(অরণ্য পলাশ),

‘ইন্দুবালা’ (অনন্য মামুন), ‘হৃদয় জুড়ে’ (রফিক শিকদার), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (অনিরুদ্ধ রাসেল), ‘ম্যাকআপ’ (অনন্য মামুন), ‘বেসামাল’ (রাহুল রওশন), ‘এনকাউন্টার’ (অনিরুদ্ধ রাসেল), সরকারি অনুদানে নির্মিতব্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত খ্যাতিমান চিত্রপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত 'রুখসার' এবং সরকারি অনুদানে নির্মিত ‘জামদানি’ (অনিরুদ্ধ রাসেল)।

এছাড়াও তিনি আরও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন, পর্যায়ক্রমে যেগুলোর শুটিং শুরু হবে ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে।

পুরস্কার ও সম্মাননা

বিভিন্ন মাধ্যমে মিঠু মনির তার নৈপুণময় নানন্দিক সিনেমাটোগ্রাফির জন্য দেশে-বিদেশে বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—'জলছবি' নাটকের জন্য টেলিভিশন ভিউয়ার্স ফোরাম অফ বাংলাদেশ (টিভিএফবি) স্টার পুরস্কার ২০২১-এ সেরা নাট্য চিত্রগ্রাহক অ্যাওয়ার্ড, 'গন্তব্য' চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ বিনোদন সাংবাদিক সমিতি (বাবিসাস) ২০২২-এ সেরা চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক অ্যাওয়ার্ড, ‘কিপ্টাশ্বশুর' নাটকের জন্য টেলিভিশন ভিউয়ার্স ফোরাম অফ বাংলাদেশ (টিভিএফবি) স্টার পুরস্কার ২০২২-এ সেরা নাট্য চিত্রগ্রাহক অ্যাওয়ার্ড, 'হৃদয় জুড়ে' চলচ্চিত্রের জন্য আমেরিকার লসএনজেলসে অনুষ্ঠিত, বাংলাদেশ কমিউনিটি অফ প্রেস্টিজিয়াস ফেস্টিভল আয়োজিত আনন্দ মেলা স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০২৫-এ সেরা চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক অ্যাওয়ার্ড।

ভালোবাসার জায়গা: চলচ্চিত্র

বাংলাদেশের টিভি নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে  মিঠু মনিরের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও, তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন চলচ্চিত্রের কাজে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন—"চলচ্চিত্রের বড় ক্যানভাসে কাজ করার চ্যালেঞ্জ আমাকে আনন্দ দেয়। এখানে প্রতিটি ফ্রেমের সাথে আলো ও ছায়া নিয়ে খেলা করার ব্যাপক সুযোগ পাই। নিজেকে প্রমাণের জন্য রয়েছে অবারিত স্পেস, অর্থাৎ এখানে সিনেমাটোগ্রাফি ক’রে আমার আমিকে একজন শিল্পী হিসেবে ভাবতে পারি।”

মিঠু মনির, স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে সবকিছুর আগে তা পড়েন গভীর মনোযোগে। কারণ, ফ্রেম সাজানোর জন্য কেবল ক্যামেরার জ্ঞান নয়, দরকার অনুভব করার ক্ষমতা। এই অভ্যাসই তাকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। তার প্রিয় সিনেমাটোগ্রাফারদের তালিকায় আছে—কামরুল হাসান খসরু ও রাশেদ জামান। উল্লেখ্য, মিঠু মনির তার অনন্য দক্ষতায় রফিক শিকদারের 'হৃদয় জুড়ে' চলচ্চিত্রের গানগুলো চিত্রায়ন করেন। এর স্বীকৃতি স্বরূপ কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক বেলাল খান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। 

এক শিল্পীর জীবনদৃষ্টি

মিঠু মনির বলেন—"ক্যামেরা আমার কাছে শুধু একটা যন্ত্র নয়, এটা আমার চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম। আমি আলো আর ছায়া দিয়ে আঁকি অনুভবের ছবি। আমি চাই, আমার প্রতিটি কাজ দর্শকের মনে দাগ কাটুক, একটা অনুভূতি জাগিয়ে তুলুক। আমি ক্যামেরার শিল্পী হয়ে বাঁচতে চাই।"

এই কথাগুলো শুধু আত্মবিশ্বাসের প্রকাশই নয়, একজন শিল্পীর সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন।

পরিশেষে

মিঠু মনির বাংলাদেশের এমন একজন সিনেমাটোগ্রাফার, যিনি দৃশ্যের আড়ালে থাকা আবেগ, চরিত্রের নিঃশব্দ দোলাচল এবং সমাজের অতল সত্যকে তুলে আনেন এক অনন্য দৃষ্টিতে। তার ক্যামেরার ভাষা আমাদের চোখ দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে শেখায়। সরকারি অনুদানে নির্মিত মুক্তি প্রতিক্ষীত ‘জামদানি’ চলচ্চিত্রটি, বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত প্রি-ভিউ কমিটির বোদ্ধা সদস্যগণ দেখার পরে—এর সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে এক মন্তব্যে বলেন—‘জামদানি’ চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সিনেমাটোগ্রাফি এক জীবন্ত চিত্রকলার নাম—যেখানে প্রতিটি আলো, প্রতিটি রঙ, প্রতিটি কম্পোজিশন এক একটা কবিতার মতো।

মিঠু মনির, আপনি শুধু দৃশ্যধারণ করেন না, আপনি সময়কে ক্যামেরায় বন্দি করে রাখেন। আপনার প্রতিটি কাজ মনে করিয়ে দেয়—চলচ্চিত্র কেবল গল্প নয়, এটি একটা অনুভূতি, একটা শিল্প, একটা জীবন।

জাতীয়

আরও পড়ুন