দেশে এক বছরে নতুন এইচআইভি এইডস রোগী বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন আনুমানিক দুই হাজার মানুষ। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪৩৮ জন। এ সময় এইডসে মারা গেছেন ২০০ জন, যা আগের বছর ছিল ১৯৫। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা, কুষ্ঠ ও এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (টিবি-এল অ্যান্ড এএসপি) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, নতুন শনাক্ত রোগীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সমকামী পুরুষ। ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ ও চিকিৎসা পরামর্শ না নেওয়ার কারণে রোগী বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। ঘনবসতি, অনিয়ন্ত্রিত আচরণ এবং উচ্চ ঝুঁকির জনগোষ্ঠীর একাংশ চিকিৎসার আওতায় না আসায় রাজধানীতে রোগী বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এমন বাস্তবতায় আজ সোমবার নানা আয়োজনে বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘সব বাধা দূর করি, এইডসমুক্ত সমাজ গড়ি’। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি শনাক্ত হওয়ার পর এবারই এক বছরে আক্রান্ত সর্বোচ্চ। বর্তমানে শনাক্ত মোট এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৬৩ জন। তাদের মধ্যে দুই হাজার ২৮১ জন মারা গেছেন। এখনও চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং নিয়মিত সেবা পাচ্ছেন আট হাজার ৩০৯ রোগী।
রাজধানীর মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্তদের সেবা দেওয়া হয়। গতকাল রোববার দুপুরে হাসপাতালটির তৃতীয় তলার বেঞ্চে মাস্ক পরে নীরবে বসে ছিলেন ২১ বছর বয়সী সুমন (আসল নাম নয়)। কথা বলতে চাইছিলেন না। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কিছুক্ষণ পর জানালেন নিজের অসুস্থতার কথা। বললেন, এইডসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই মাস এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, নিয়মিত ওষুধ নেওয়ার জন্যই এসেছি। উত্তরার একটি বেসরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করি। ছোটবেলা থেকেই নাটক-সিনেমার প্রতি আগ্রহ। সেই স্বপ্নেই উত্তরার একটি অভিনয় প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যাতায়াত শুরু করি। সেখানে পরিচয় হয় সিনিয়র কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে।
তিনি জানান, দ্রুত প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশায় এক সময় কেন্দ্রটির এক পুরুষ সদস্যের সঙ্গে নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরে জানতে পারেন, ওই ব্যক্তির যৌনবাহিত রোগ ছিল। দুই মাস আগে হঠাৎ শরীরে র্যাশ দেখা দিলে উত্তরার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি রক্ত পরীক্ষা করান। সেখানেই প্রথম এইচআইভি পজিটিভ আসে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আরেক দফা পরীক্ষা করাতে বলা হয়। সেখানেও একই ফল আসে। এরপর থেকেই মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত ওষুধ নিচ্ছেন সুমন। কিন্তু পরিবারের কেউই এখনও জানে না তাঁর এই অসুস্থতার কথা।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় তলার বারান্দার মেঝেতে শুয়ে ছিলেন ২৪ বছর বয়সী রুবেল হোসেন। তাঁর মাথার কাছে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে উদ্বিগ্ন চোখে ছেলেকে দেখছিলেন মা-বাবা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুবেলের বাবা মোরশেদ আলী বলেন, আট বছর ধরে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করত রুবেল। কাজের সুবাদে বিভিন্ন সময় একাধিক মেসে থেকেছে। দুই মাস আগে রুবেলের যক্ষ্মা ধরা পড়ে। পরে শরীর আরও খারাপ হলে মস্তিষ্কে সংক্রমণ সন্দেহে চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১৭ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাঁর এইচআইভি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। রুবেল জানান, মেসে থাকাকালে সহকর্মী কয়েকজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ১৮ দিন ধরে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। পরিবারের ভাষ্য, প্রতিদিন রুবেলের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এখানে এইচআইভি সন্দেহে দুই হাজার ৪৮৬ জনের পরীক্ষা করা হয়। তাদের মধ্যে ১৮৪ জনের এইচআইভি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্ত ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ ১৪১, নারী ৩৮ ও হিজড়া চারজন। এদের মধ্যে ৭১ জনই সমকামী পুরুষ।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ১০৭ জন বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। মা-বাবার মাধ্যমে জিনগত সংক্রমিত হয়েছেন ১০ জন। প্রবাস থেকে সংক্রমণ নিয়ে দেশে ফিরেছেন ৪২ জন। একই সময়ে হাসপাতালে এইডস সম্পর্কিত জটিলতায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়; তাদের মধ্যে সাতজন চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মারা যান। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে এই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত হাসপাতালে দুই হাজার ১৯২ জনের পরীক্ষা করা হয়। এ সময় ২৭৩ জনের শরীরে এইচআইভি ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে পুরুষ ২১৫, নারী ৫৭ ও হিজড়া একজন। সংক্রমিতদের মধ্যে পুরুষ সমকামী ৭৮ জন, পুরুষ যৌনকর্মী ৩৯ জন ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর ১৩৮ জন। একই সময়ে হাসপাতালে মারা যান ৩৫ রোগী।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, এখন এইচআইভির চিকিৎসার ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত। তবু আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। এটার কারণ খোঁজা জরুরি। একটা কারণ হতে পারে, নিয়মিত ও যথাযথ চিকিৎসা নিচ্ছেন না আক্রান্ত ব্যক্তিরা। আবার যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, তা প্রতিরোধী হয়ে উঠছে কিনা, সে বিষয়েও নজর দেওয়া দরকার। এ ছাড়া সমকামীদের মধ্যে নতুন শনাক্তের হার যেভাবে বাড়ছে, তা এখনই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জোরদার না করলে ভবিষ্যতে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
এইচআইভি রোগী শনাক্তে বাড়ছে বৈচিত্র্য : সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নতুন এইচআইভি রোগী শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। পাশাপাশি বিদেশফেরত শ্রমিক এবং দুই পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্কে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে যুক্ত কিছু ব্যক্তির শরীরেও শনাক্ত বাড়ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার। তিনি বলেন, এইচআইভি রোগীরা নিয়মিত বিনামূল্যে ওষুধ পেলেও জটিল রোগীর চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষায়িত ল্যাবরেটরি, এমআরআই, বায়োপসি, সিডি-৪ কাউন্টের মতো পরীক্ষার সুবিধা এখানে নেই। ফলে রোগীকে এসব পরীক্ষা বাইরের প্রতিষ্ঠানে করাতে হয়।
চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ : হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, রোগীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক ও পরজীবী সংক্রমণ দেখা গেলে তা নির্ণয়ের উন্নত ব্যবস্থা নেই। নেই ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থাও। জনবল সংকটের কারণে জটিল রোগীর লাইফ সাপোর্ট দিতেও সমস্যা হয়। পাশাপাশি উন্নতমানের অনেক অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহও সীমিত।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক রোগীর স্বজন জানান, গুরুতর ছত্রাক সংক্রমণে ব্যবহৃত লাইপোজোমাল অ্যাম্ফোটেরিসিন বি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এক ভায়ালের দাম প্রায় ১৭ হাজার টাকা। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে ২৫টি পর্যন্ত ভায়াল লাগে। খরচ বহন করতে না পারায় অনেকেই পুরো চিকিৎসা নিতে পারেন না।
রোগীর ধরন বদলাচ্ছে : হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. এ আর এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোগীর ধরন বদলাচ্ছে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর মধ্যে প্রবাসফেরত পুরুষ শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষ রয়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের পরিবর্তন বা সচেতনতার অভাবই তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। হাসপাতালের তথ্য বলছে, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর প্রায় অর্ধেকই বিদেশফেরত শ্রমিক। উল্লেখযোগ্য অংশ আবার ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ।