• ঢাকা
  • সোমবার , ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ , রাত ১২:১৪
ব্রেকিং নিউজ
হোম / উপসম্পাদকীয়
বিপন্ন পর্বত: জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তা রক্ষায় জরুরি বার্তা

বিপন্ন পর্বত: জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের নিরাপত্তা রক্ষায় জরুরি বার্তা

প্রিন্ট ভিউ

রিপোর্টার : অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

পর্বত কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়; বরং জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য, পানি নিরাপত্তা, খাদ্য উৎপাদন ও মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এক জটিল বাস্তুতন্ত্র। পৃথিবীর ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জুড়ে রয়েছে পর্বত ও একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্র। অথচ ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব নীতির অভাবে এই পর্বত ব্যবস্থা আজ বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি। এই বাস্তবতায় প্রতিবছর ১১ ডিসেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। যার উদ্দেশ্য পর্বত অঞ্চলের পরিবেশগত গুরুত্ব, মানবজীবনে এর অবদান এবং ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বিষয়ে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা। জাতিসংঘ ২০০৩ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করে আসছে। ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের মতে, বিশ্বের মোট ভূমির প্রায় ২৪ শতাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে পর্বত, যেখানে বসবাস করে বিশ্বের মাত্র ১২–১৫ শতাংশ মানুষ। তবে পর্বতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। কারণ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান নদীগুলোর উৎস পাহাড়েই। হিমালয়কে বলা হয় “এশিয়ার জলাধার” যেখান থেকে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদী উৎপন্ন হয়ে কোটি কোটি মানুষের পানীয় জল, কৃষি ও অর্থনীতিকে সচল রাখছে। ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পর্বতাঞ্চল থেকে বিশ্বব্যাপী মোট ৫০ শতাংশ মিঠা পানি সরবরাহ হয়। এছাড়া, বিশ্বের মোট স্বাদু পানির প্রায় ৭০ শতাংশ সংরক্ষিত রয়েছে হিমবাহে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে এসব হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে যা আকস্মিক বন্যা, ভূমিধস ও ভবিষ্যৎ পানিসংকটের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট বা ইসিমোড এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হিমবাহ ২০১১ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ৬৫% দ্রুত গলছে। শুধু এতটুকুতেই পর্বত বা পাহাড়ের ভূমিকা সীমাবদ্ধ নয়। পর্বতসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য হটস্পট। কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৩৪টি জীববৈচিত্র্য হটস্পটের মধ্যে ২৫টিই পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এখানে বসবাস করে অসংখ্য বিরল ও এন্ডেমিক প্রজাতি। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পাহাড়ের মাত্র ১০০ মিটার উচ্চতা পরিবর্তনের ফলে যে জলবায়ুগত বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়, সমতল ভূমিতে তা প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভ্রমণের সমান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছে। আন্তঃসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (IPCC) অনুযায়ী, পর্বত অঞ্চলের প্রায় ৮৪ শতাংশ এন্ডেমিক প্রজাতি আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদকে উচ্চতর অঞ্চলে সরে যেতে হচ্ছে, আবার অনেক ক্ষেত্রেই টিকে থাকার সুযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে একটি বায়োডাইভার্সিটি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর স্থলভাগ, মহাসাগর, উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ জলভাগের ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের অঙ্গীকার করা হয়েছে যা পর্বতভূমি পুনরুজ্জীবিত করা ও সুরক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা হিসেব ভূমিকা রাখবে।

পর্বত কেবল প্রকৃতির নয় বরং মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিরও আধার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হিন্দুকুশ–হিমালয় অঞ্চলের কথা যেখানে ১,০০০টির বেশি ভাষা ও উপভাষা প্রচলিত রয়েছে। এটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন। পর্বতভিত্তিক কৃষি ও পণ্য, যেমন চা, কফি, জাফরান, ধান, বেরি ও ঔষধি উদ্ভিদ লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করেছে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন, কেনিয়া ও তুরস্কে চা শিল্প পাহাড়ি অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাহাড়ি মানুষের প্রায় ৮০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং প্রায় ৩০ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আমাদের দেশেও প্রায় একই চিত্র দেখা যায়। পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের ২০২২ সালের দারিদ্র্য মানচিত্রে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ২ শতাংশ হলেও তিন পার্বত্য জেলায় ৪৮ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে অতিদরিদ্র্যের সংখ্যা বান্দরবানে ২৫ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে প্রায় ১৬ শতাংশ ও রাঙামাটিতে সাড়ে ১৪ শতাংশ। 

বাংলাদেশকে সমতল নদীমাতৃক দেশ হিসেবে দেখা হলেও দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র। অথচ এই অঞ্চল আজ গভীর হুমকির মুখে। বায়ূমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর এক জরিপে পার্বত্য অঞ্চলে বায়ূ দূষণের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে দেখা গেছে পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে খাগড়াছড়ির অবস্থা তুলনামূলকভাবে বেশ খারাপ, গড় পিএম ২.৫ এর মান ৯৮.১৭ যেখানে রাঙামাটি ও বান্দরবানের ক্ষেত্রে এই মান যথারীতি ৮৪.০১ ও ৯৮.১৭। সরকারি ও গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এক যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার হেক্টরের বেশি, এবং ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে। ফলে পাহাড়ের মাটির বুনন নষ্ট হয়ে পুরো অঞ্চল হয়ে উঠেছে ভূমিধসপ্রবণ। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২১টি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে গড়ে ২৬ জন প্রাণ হারান এবং গুরুতর আহত হন আরও অনেকে। ২০২৪ সালে ভূমিধসে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ২০ জনই চট্টগ্রাম অঞ্চলের। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় কেটে বসতি, অতিবৃষ্টি এবং পরিবেশগত অব্যবস্থাপনাই এই মৃত্যুর মূল কারণ। যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১২ শতাংশ পাহাড়ি এলাকা। মোট ১৬ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে পাহাড়ি ভূমি। সেভ দ্য চিলড্রেনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলা হয়েছে, দেশের অন্যান্য সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিধসের পরিমাণ বাড়ছে এবং প্রতি বছর এটি চার শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত বৃষ্টির সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলে মানুষের অপরিকল্পিত বসবাসের কারণে মৃত্যুহারও বাড়ছে ভূমিধসে। এ ছাড়া ২০০৭ ও ২০১৭ সালে ভূমি ধসে মৃত্যুর হার বেশি থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়, এর আগে ওই অঞ্চলে উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে যাতে পাহাড় কাটা পড়েছে এ ছাড়া ওই সময় বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছিল। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে পাহাড় ধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটে ২১টি। এসব দুর্ঘটনায় গড়ে ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। গুরুতর আহত হন গড়ে ৫১ জন। পাহাড় ধসের জন্য মূলত টিলা কেটে বসতি তৈরিকে মূল কারণ হিসেবে মনে করে সংস্থাটি। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, এসব দুর্ঘটনা আর্থসামাজিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক সমস্যারই প্রতিফলন।  সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ট্রাস্টি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ ২০১৭ সালে যৌথভাবে একটি গবেষণা করে। যেখানে বলা হয়েছে, এক যুগে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ধরনের বনভূমি কমেছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ৩৬ হেক্টর। আর ৬১ শতাংশ পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে গেছে। এর ফলে এই অঞ্চলের পাহাড়ের মাটির বুনন নষ্ট হয়ে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

আন্তর্জাতিক পর্বত দিবসের মূল বার্তা হলো, পর্বতকে রক্ষা করে উন্নয়ন নিশ্চিত করা।  টেকসই পাহাড় ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে বন সংরক্ষণ ও পুনঃবনায়ন, পাহাড় কাটা নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পাহাড় আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ তাই একে যথাযথভাবে রক্ষা করার জন্য সকল ধরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ঠ থাকতে হবে। পাহাড় কেটে পর্যটনস্পট গড়ে না তোলে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের প্রতি গুরুত্বারোপ করাতে হবে।  এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন না হলে পর্বতের ক্ষতি শুধু পাহাড়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না; সমগ্র পরিবেশ ও মানবসমাজ এর পরিণতি ভোগ করবে। সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং সম্মিলিত উদ্যোগই পারে পাহাড়কে বাঁচাতে। আর পাহাড় বাঁচলে, মানুষও বাঁচবে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)।




মতামত

আরও পড়ুন